শ্রমিকের নেই কোনো কপিরাইট (তৃতীয় পর্ব)

কত লোক ঘরে ফিরল অবশেষে? ছবি: Financial Times

দ্বিতীয় পর্বের পর

লকডাউন ৪

কত লোক ঘরে ফিরল অবশেষে? সরকারের কাছে তার পাক্কা হিসেব আছে। ঘরের ফেরার আনন্দে এরা গান গাইতে পারেনি। আসলে সমস্ত যাওয়া আসার তো একটা দায় থাকে। সেই দায়ের ভারেই সুর গম্ভীর হয়ে যায়। সরকার চিন্তিত পরিযায়ী মানুষরাই হয়তো বাড়িয়ে দেবে সংক্রমণ। এ-নিয়েই চলছে তরজা। এ তো মিথ্যে নয়, যে আসছে সে-ই ছড়াচ্ছে এই রোগ। প্রতিবার সে ঘরে ফিরলেই অন্তত জনা দশেক মানুষ আসেন খোঁজ নিতে, পরিযায়ী হওয়ার উপায় জেনে যায়। আতংকের সংসারে একটু ভালো থাকতে পারার স্বপ্ন সংক্রামিত হয় দ্রুত। এই সংক্রমণের হিসেব কিন্তু সরকার জানেন না। ‘বিকাশে’র কাজে সরকারের সাফল্য কেবল ওই চূড়াটাতে, নীচে তাকে কে, কারা, কতজন ধরে রইল, পিশে গেলো, তার খবর রাখার কাজ কেউ দেয়নি তাদের। আমরাও ভাবি না। কথায় আছে, ফল খাও গাছের পাতা গুনে কী হবে? পেয়ে যাচ্ছি, দখল করে নিচ্ছি, কিন্তু তার মালির খবর রাখছি না৷ অথচ দায় চাপিয়ে দেওয়ার বেলায় এক আনাও বাকি রাখতে নারাজ আমরা।

চায়ের দোকানে সেদিন প্রবল শোরগোল। এক্সপ্রেসওয়ের ধারে একটা প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের কাছে পরিযায়ীদের রাখার ব্যবস্থা হয়েছে। কোনোক্রমে চা খেয়ে ছুটছে সকলে। হ্যাঁ, এই আশ্চর্য জীবদের দেখবার ইচ্ছে হওয়াটা আশ্চর্যের নয়। আগে শুনেছি বিদেশ ঘুরে এলে লোক জড়ো হত। এখন পরিযায়ীরা এলে। ফিরে এসে কেউ কেউ গালি দিলো, গিয়েছিল কেন বাইরে? আর যাবি? ইত্যাদি। তার সপ্তাহখানেক পরেই খবর দেখলাম অনেকেই ফিরতে চায় যার যার কাজে। প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা। এবার আপনি বলবেন, বেইমানের জাত। হ্যাঁ, তার দায়ও চাপিয়ে দিতে পারি আমরা। এরা কোনো উত্তর দেবে না৷ কী-ই বা আসে যায় এদের। প্রতিদিনের জীবনের ঝামেলায় এরা কোনো ময়দান আন্দোলনেও যায় না। খুব রেগে গেলে গালি দেয়। প্রেশারকুকারের মতো। ভাবনার জন্য যে ফাঁকা রাস্তার প্রয়োজন হয় জীবনে, তার সৌভাগ্য ক-জনের হয়? সবাই তো আমি নই! যেমন ধরুন ভাবতে ভাবতে চলে এসেছি সেন্ট্রাল জেলের পেছনের রাস্তায়। এই রাস্তায় আরও গভীরে ভাবা যায়। একদম ফাঁকা রাস্তা। একপাশে পুলিশ কোয়ার্টার, অন্য পাশে জেশপ নামের এক বিশাল শিল্পদৈত্যের মৃতদেহ। ফলে, এ-রাস্তা তেমন মাড়ায় না কেউ। আমি যাতায়াত করি। এমন নির্জন মৃত্যু উপত্যকার ওপরেই ভাবনা চলে ভালো।

ভেঙেছে, তবে গড়বে কিনা সে উন্নয়নই জানে। ছবি : Vatican News

সংক্রমণের হিসেবে সামনের সারিতে এগোচ্ছিলাম আমরা। এর মাঝেই ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল বাংলার একাংশ। এবার ত্রাণের পালা। সরকার শেষ পর্যন্ত মেনে নিলেন ত্রাণ আগেও যেভাবে পাঠানো হয়েছিল, তাতে পার্টি অফিসের আশপাশ ত্রাণে উপকৃত হলেও আশি শতাংশ বাড়ি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি আজও। এবার সরাসরি ব্যাঙ্ক একাউন্টই ভরসা৷ তাতেও যারা পেলেন তাদের চাল খুলে নেওয়া হয়েছিল বছর দশেক আগেই, যখন তারা নিজেরাই ছাদ পাকা করেন। তবু পেলেন, পাচ্ছেন। আসলে নেপোটিজম বলে এক বস্তু রাজনীতিতেও সক্রিয়, এদিকে বলিউডের দোষ দেখেই আমরা দিন কাটাই খালি!

শোনা যাচ্ছে উঠে যাবে লকডাউন। বিশ্বাস করুন, আমিও মনে করি, এই লকডাউন নামক মজার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ রোগের বিরুদ্ধে লড়তে যা প্রয়োজন ছিল তা যখন এই প্রায় তিনমাসেও সরকার করতে পারল না, একশো বছর লকডাউনেও তা করতে পারবে না এই সিস্টেম। কথায় আছে, যার আটে হয় না তার আশিতেও… আসলে, মুক্ত বাজারে যা থেকে মুনাফার ভিড় বাড়ানো যায় তাকে সাধারণের কাছে সহজলভ্য করতে নেই। মার্কেট-পলিসি বলেও তো একটা ব্যাপার আছে নাকি? আপনি বলবেন, তাহলে রেশন কেন? খাদ্য, স্বাস্থ্যের থেকেও লাভজনক বিনিয়োগ, তাহলে তা সরকারের হাতে কেন? কারণ দুটো, এক যারা সরকারের চূড়াটিকে ধরে রাখে বেদিতে তারা যাতে ভেঙে না যায়, তাই ততটুকুই দাও যা ওইটুকুর শক্তি দেবে, আর দুই, এখান থেকে লোকাল স্তরে পার্টির খানিক ফান্ড তুলে নেওয়া যাবে। এই দুটোই ঠিক পুঁজিবাদের শুরুর দিকের গড়ে ওঠা সত্যি, আজও চলছে তবে তা একটু আড়ালে-আবডালে। যেমন ধরুন, শয়ে শয়ে শ্রমিকের পায়ে হেঁটে ফেরা দেখে আজন্ম পুঁজিবাদের পূজারীরা হঠাৎ মার্কসতত্ত্ব আওড়াতে শুরু করলেন, কিন্তু পরিস্থিতি একটু শান্ত হলেই তাদের দাবিতে কোনো ধর্মঘটের বিরুদ্ধে লাগাতার বলতেও পিছু ছাড়বে না।


এতক্ষণ পড়ে নতুন কিছু পেলেন না তো? নতুন কিছুই তো বলতে আসেনি। চেনা সত্যি, যা আমি আপনি প্রতিদিন দেখি, শুনি অথচ এড়িয়ে চলি, তাকে বারবার সামনে আনতে হয়। এ-ও বাজার থেকেই শিখেছি। মনে করে দেখুন, ম্যাগির বিজ্ঞাপন দিনে কতবার দেখেন, অথচ আপনি তো জানেন ম্যাগি সহজে বানিয়ে খাওয়া যায়, খানও। কিন্তু মজা হল কোনোদিন পাড়ার দোকানে ম্যাগি নেই, টপরামন কিনলেন। খাচ্ছেন ঘরে বসে, বন্ধুর বা বান্ধবির ফোন এলো, জানতে চাইল কী খাচ্ছেন, আপনি চট করে উত্তর দেবেন ম্যাগি খাচ্ছি। একই চেষ্টায় আমিও আছি, চোখের সামনে ঝুলিয়ে ঝুলিয়েই একদিন আপনার মনে একটু জায়গা বানিয়ে নেবে পাটাতনের নীচের মানুষগুলো। পরিযায়ী নয়, মানুষ হিসেবে পরিচয় হবে তাদের। ঠিক তেমন, যেমন গুজরাট থেকে এসে রাষ্ট্রপ্রধানের চেয়ারে বসা একজনকে আমরা পরিযায়ী প্রধানমন্ত্রী বলি না। বলি, ভারতের প্রধানমন্ত্রী।

পরিযায়ী নয়, মানুষ হিসেবে পরিচয় হবে তাদের। ছবি: Financial Times

চলবে…

Leave a Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *