শ্রমিকের নেই কোনো কপিরাইট (দ্বিতীয় পর্ব)

লকডাউন ৩

এক

সপ্তাহে দু-তিনদিন করে অফিস যাচ্ছি সবে। অফিস পরিষ্কার করে রাখাই উদ্দেশ্য। বিকেল হওয়ার আগেই বাড়ির পথে। কিরীটীদাকে বাড়ি পৌঁছে ফেরা। সেদিনও বিকেলে অফিস থেকেই ফিরছি। সোদপুর পৌঁছোতে মিনিট পনেরো বাকি। এক্সপ্রেসওয়ের পাশে একটি মাত্র চায়ের দোকান খোলা দেখে দাঁড়ালাম। দুজনেরই প্রবল দ্বিধা, পুলিশ এসে পড়লে কী হবে! দোকানির ওদিকে নজর নেই। তিনি খদ্দের পেয়ে জানতে চাইলেন ‘বড়ী না ছোটো’। চায়ে চুমুক দিয়েই জানতে চাইলাম, পুলিশ আসছে না? রোগা দোকানি, কোটরে ঢুকে যাওয়া চোখ তুলে তাচ্ছিল্যের ঢঙে বললেন, হ্যাঁ আসছে। আসলেই ঝাপ ফেলে দিচ্ছি। না-হলে মালপত্র নিয়ে টানাটানি করছে। সেদিন বললাম, দোকান বন্ধ থাকলে খাব কী? পুলিশ বলল, সরকারকে গিয়ে বলো। আমরা জানতে চাইলাম, রেশন পাচ্ছেন না? বলল, হ্যাঁ, এ-সপ্তাহে পনেরো দিনের জন্য এক কিলো করে তিনজনের তিন কিলো চাল পেয়েছে। কিন্তু বরাদ্দ তো বেশি? সেগুলো ডিউ। মেয়ে স্কুল থেকে তিন কিলো চাল আর তিন কিলো আলু পেয়েছে তাতেই চলছে। স্বামীর টোটো আছে কিন্তু সে-ও বসা… তাই দোকান খুলতেই হবে।

গল্পটা করলাম দু-একজন বন্ধুকে। তাদের বক্তব্য, আরে সেদ্ধ ভাত খাক। কিন্তু দোকান খুলবে কেন? আমি জানতে চাইলাম সেদিন লাঞ্চে কী খেলো? মেনুতে মাছ ছিল আমার বন্ধুর।

গণবণ্টনে আমাদের দেশে বাংলা পথপ্রদর্শক হতে পারত। যে মানুষ জমি চষলো, দাম পেলো না, তার দায় রাষ্ট্রের আছে বইকী! কারণ, সেই চাষিও তার শ্রমকে ইনভেস্ট করেছে দেশ গঠনেই। এই সহজ কথাটুকু না আমরা বুঝি, না সরকার বুঝতে দেয়। সরকার সব করে দেওয়ার দলে। যেন তার মন্ত্রিসভাই মাঠে চাষ করে মুখে তুলে দিলো ভাত, ডাল… এ-যে সমষ্টির সম্পদ, এতে যে সমষ্টিরই অধিকার সব্বার আগে, তাই ভুলিয়ে দিয়েছে রাষ্ট্র। আপনার ঘরে আপনাকেই ভিক্ষে করে খেতে হবে, এমন দয়ার নামই রাষ্ট্র। বরাদ্দ চাল ডিউ হল, ডিউ চাল খুঁজে পাওয়া গেল শাসকের পার্টি অফিস থেকে। আর যেখানে পুলিশ রেইড করল না, তাই বিক্রি হল সস্তা দামে, ত্রাণের নামে।

ওদিকে ট্রেন চালু হল। স্পেশাল ট্রেন। দেশের নানান জায়গায় আটকে-থাকা মানুষ ফিরবেন। সমস্ত ট্রেনই এসি। ভাড়া স্বাভাবিকের থেকে বেশ কয়েকগুন। সরকার বেসরকারি পদ্ধতি নিলো। যেমন ডিম্যান্ড তেমন দাম। মানুষ বাধ্য হল যাতায়াত করতে। ওদিকে দেদারে চলল কালোবাজারি। আসলে, রাষ্ট্র বুঝিয়ে দিলো কর্পোরেট দরাদরিকারীকে, গণপরিবহনে ইনভেস্টমেন্ট কতটা লাভজনক।

দুই

“দেশটা একদিন প্রাইভেট লিমিটেড হয়ে যাবে।“ কট্টর বিরোধীদের খেদ এ-সব। আসলে আজ চোখে পড়ছে বেশী করে। শুরু তো সেই কবেই হয়েছে। আশির দশকে। রাজীব গান্ধী তখন প্রধানমন্ত্রী। প্রথম ভাবনা আসে শিক্ষাক্ষেত্রে বেসরকারি বিনিয়োগের। ভেবে দেখুন, যে পাঁচটি মৌলিক অধিকার ভারতবাসী হিসেবে আমার-আপনার পাওয়ার কথা, তার দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করছে সরকার। ফলাফল দীর্ঘ সময়ের পুষ্টিহীন শিক্ষাব্যবস্থা। তা, কী সেই অধিকার? অন্তত এম.এ পাশ না করলে তার সম্পর্কেও স্পষ্ট ধারণা হয় না আমাদের। এই অধিকার ব্যপারটা অনেকটা এই করোনাকালের রেশন বরাদ্দের মতো। বরাদ্দ টাঙানো হয়েছে রেশন দোকানের সামনে। পরিষ্কার ইংরেজিতে লেখা নির্দেশ, কে কত চাল, গম ইত্যাদি পাবেন, কিন্তু লম্বা লাইনে দাঁড়ানো মানুষগুলো কিছুই জানেন না। কখনও কেউ এসে পড়েও দেখেননি ওই নির্দেশ। আর ডিলারও জানেন ও পড়ার মতো বিদ্যে তার উপভোক্তাদের নেই। ফলে ডিউ-এর নামে হাজার হাজার কুইন্টাল চাল বিক্রি হয়ে যাচ্ছে পেছনের দরজায়। খাদ্যমন্ত্রী অজান্তে রেকর্ড করে ফেলেন কোন এলাকার কাউন্সেলার কত চাল চুরি করছেন। রাজ্যেরটা রাজ্যের রক্ষীরা, কেন্দ্রেরটা কেন্দ্রীয় রক্ষীরা লুট করছেন। তারপর আসে লোন মাহাত্ম্য। প্যাকেজ। যে বাজারে চাহিদাই নেই, সেই বাজারে লোন কত মানুষকে সচল, রোজগেরে বানাতে পারবে, অর্থনীতিতে ফার্স্টক্লাস পাওয়া অধ্যাপকও হলপ করে বলতে পারছেন না।

যাই হোক, এই কর্মহীন, অশিক্ষিত দেশে লকডাউন। পুলিশে ভরসা রেখেছে রাষ্ট্র। প্রিভিলেজ ক্লাস হোম আইসোলেশনে। স্বামী-স্ত্রী মিলেমিশে রান্না করেন, পরিবার কেউ কেউ ধুলো জমা হারমোনিয়াম আর স্টার মেকারে শিল্পীসত্তা জাগিয়ে তোলেন। গালি দিতে দিনে দু-তিনটে পোস্ট ফেসবুকে বা টুইটারে, “মানব সভ্যতা শেষ করে দেবে এই বাজারপ্রিয়, জটলাপ্রিয় লোকগুলো।” ছোটো ছোটো ক্লিপিং আসে, পুলিশ পিটিয়ে ভেঙে দিয়েছে বাজারের দোকান, রাস্তায় ছড়ানো কাঁচা সব্জি। ধারবিতে এক বাবা তার সন্তানের জন্য জল আনতে খোলি থেকে বেরিয়ে রাস্তার কলে যাওয়ায় মুম্বাই পুলিশ বাড়ি পর্যন্ত তাড়া করে এসে সন্তানের সামনেই বেধরক পেটাচ্ছে। স্ত্রী অসহায়ভাবে বাঁচাবার চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ। ফরিদাবাদে এক বাইকচালক যুবককে এক লাঠির ঘায়ে নাক, মুখ ফাটিয়ে দিয়ে রাষ্ট্রীয় উল্লাসে মেতে ওঠেন প্রশাসক থেকে প্রিভিলেজড নেটিজেনেরা, আর রাষ্ট্র বুঝে নেয় তার শাসন এবং শোষণযন্ত্রে জং পড়েনি তো? বিভিন্ন সরকারি অফিসে লেখা থাকে “সরকারি সম্পত্তি নষ্ট করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ”। রাস্তায় পুলিশের লাঠি আর রাষ্ট্রের পায়ের তলায় পিষে নষ্ট হওয়া ফসলগুলোও যে রাষ্ট্রের সম্পত্তি তা রাষ্ট্র ভুলে গেলো কেমন করে? চলবে…

প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন

Leave a Reply

One response to “শ্রমিকের নেই কোনো কপিরাইট (দ্বিতীয় পর্ব)”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *