যে লেখা চাওয়া হয়েছে

প্রিয় শুভদীপ,

তোমার প্রবল তাড়া পেয়েছি একটি লেখা জমা দেওয়ার জন্য। তুমি জানিয়েছিলে ‘সাহিত্য’ বিষয়ে কিছু একটা লিখতে। জানি না, আমায় কেন সাহিত্য নিয়ে লিখতে বললে? এ যে মানুষকে বলা স্বর্গ তৈরি করবার জন্য। আমি এই মহান দায় নিতে পারলাম না। তবে কিছু কথা বলি ‘যাপন’ নিয়ে। এ তোমার পত্রিকার জন্য প্রযোজ্য হবে কিনা তা ভেবে দেখার দায় তোমার। কারণটা তুমি জানো। আগের বারও একটি লেখা দিয়েছিলাম তোমারই অনুরোধে। তারপর আর যোগাযোগ করনি। না, তাতে আমার দুঃখ নেই। আমাকে জানাবারই বা কী আছে! আমি যা তোমায় দিলাম তার দায় তোমার। তুমি দায়িত্ব নিয়েছিলে সেটা পাঠকের কাছে পৌঁছে দেবে বলে। আমি তো সরাসরি পাঠকের কাছে পৌঁছতে পারি না। তোমরাই আমার মাধ্যম। কাজেই এই লেখার দায়ও তোমার উপরেই ছাড়লাম।

বেশ কিছুদিন থেকেই ভাবছিলাম তোমায় কী বিষয়ে লেখা দেবো। শেষে ঠিক করলাম, তোমায় উদ্দেশ্য করে একটা চিঠি লিখি। বিষয় আমার প্রতিদিনের যাপন। দ্যাখো ভাই, আমি সন্ন্যাসী নই। আমি সাধনা করি না। আমি কেবল খোঁজার চেষ্টা করি,এই পৃথিবীতে আমার আসার পেছনে আসলে কি উদ্দেশ্য আছে? এবার তুমিও প্রশ্ন করতে পারো, “আরে বাবা, চেয়েছিলাম লেখা, তা না দিয়ে এই জ্ঞানগর্ভ পত্র কেন? আমার কী প্রয়োজন এই যাপন জেনে?” না, কারোর কোনও কাজ নেই জেনে। তবু লিখছি কারণ মাঝে মাঝে নিজেকেও তো নিজে দেখতে হয়! আয়নার মত করে। তাই এই চিঠি। ওই যে বললাম, তুমি পড়ে ফেলে দিতে পারো। আর আমি, তোমায় লেখা দিয়েছি বলে ভুলে যেতে পারি এই চিঠিটাকে, কথাগুলোকে কেবল মনে রেখে দিলাম।

দ্যাখো, আজকাল সাহিত্য লেখাটা যেন একটা নিত্য প্রয়োজনীয় বস্তুতে পরিণত হয়েছে। সব্বাই লেখেন। আবার সকলেই ভালো লেখেন। খারাপ লেখেন না কেউই। কেউ পড়েন না। কেউ দেখেন না। পড়ি না আমিও। পড়বার সময় কোথায় বল? লিখতে সময় লাগে যে। আর, দেখা? নিজেকে দেখে দেখেই বেলা ফুরিয়ে যায়, আবার কি নতুন দেখার সময় বার করবো? আমি আজ ভাবতে বসেছি আমায় লিখতে হবে কেন? কোথায় মাথার দিব্বি দিয়ে এসেছি যে লিখতেই হবে? শোনো ভাই, আমি আজ জনসমক্ষে ঘোষণা করছি, আমি লেখক নই। আমি লিখি কেবলমাত্র নিজেকে স্পষ্ট করে দেখবার জন্য। তাই আমার লেখায় সময় লাগে বেশি। আরও সহজে বললে, আমি দেখতে চাই বেশি। কি দেখি? দেখি, কীভাবে রঘুদা ভ্যান চালিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর পায়ের পেশিগুলো ফুলে ফুলে ওঠে। দেখি, গেদে লোকালে ষাটোর্ধ বাদাম বিক্রেতার গলার স্বর নেমে আসে বেলা গড়াবার সাথে সাথে। দেখি, একজন লোক রাষ্ট্রের ভণ্ডামির খবর পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েন পাশের যাত্রীর কাঁধে। আর দেখি, প্রেমিক প্রেমিকারা হাত ধারাধরি করে দাঁড়ালেও অবিশ্বাস কোনও ঘ্রাণ নিতে দেয় না। আরও দেখি, জানো? যুবকের হাত ঘুষ নেয় রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে। এবার প্রশ্ন আসে, “এসব দেখে কী হয়?” দেখি, কারণ, আমিও তো এদের মধ্যেই আছি! আমার মধ্যে এরাও জীবিত। এই যে প্রতিটি মুহূর্তের মৃত্যু কিংবা জন্ম এও তো আমারই। আমার শরীর? সেও তো সমষ্টি। আমার আত্মা, আমার অনুভব–সে কি কেবল আমারই? তাহলে কেউ না শেখাতেই প্রথম হাসতে শিখলাম কীভাবে? আর কাঁদতে?

অনন্তকাল থেকেই বহু বহু মানুষের এইসব অনুভূতি জমেছে আমার মধ্যে। তাহলে আমি আলাদা হলেম কী করে? হ্যাঁ, আজও যেটুকু আমি দেখছি, জমাচ্ছি, সে সব দিয়ে যাব আগামীর জঠরে। এ কাজটি কি কেবল আমি বা আমরাই (যারা সাহিত্য লিখি) করে যাচ্ছি? তাহলে বিশ্বাস করতে হয় আমার মা-বাবা দুজনেই সাহিত্যিক। কিংবা, এই পৃথিবীর সকল পিতা-মাতাই লেখক। তাতো নয়, ভাই। তাঁরা খুব সাধারণ মানুষ। নিজেদের দেশ হারিয়ে অন্য দেশে এসে বসা বাসিন্দা। দুবেলা ছেলেপুলেদের মুখে খাবার তুলে দিতে পারলেই খুশি। আর উৎসবের মাসে দুটো জামা-প্যান্ট। বেশ, আর কিছুই নয়। শব্দ লেখা তাঁদের কম্ম নয়। তাই তাঁরা আলাদা হতে পারেননি। আর এসবই আমরা যারা অস্বীকার করলাম তারাই সাহিত্য সৃষ্টি করতে এলেম! আহা, কি মজা!

আমি বিশ্বাস করি, এই গোটা পৃথিবী জুড়ে যে বিশাল কর্মকাণ্ড ঘটে চলছে আমি তার এক ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। যেমন বিশাল পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে নিচের সমস্ত কিছুকে ক্ষুদ্র লাগে তেমনই, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ আমি। যেমন ধরো, ইট। সে সকলের সাথে ইমারত তৈরি করে। আবার সে যখন ওই সমগ্রের থেকে বিচ্যুত হয় সে কেবল ‘রাবিশ’, বা জঞ্জাল। আমরা কেবলমাত্র নিজেদের সমস্ত কিছুর থেকে আলাদা করে নিয়ে নিজেদের শক্তি ক্ষয় করে চলেছি। এই বিচ্যুতিকে আমরাই কেউ কেউ তত্ত্ব লাগিয়ে বলে দিই, ‘ নিজেকে অনুসন্ধান করছি’। তারপর একদিন একলা হতে হতে গর্জে উঠে বলবো, ‘এ দুনিয়া আমাকে বুঝলো না’। দুনিয়া এর উত্তর দেয় না। কখনোই এর উত্তর দেয়নি সে। সমষ্টির থেকে বিচ্যুত পরমাণুকে নিয়ে ভাববার সময়ই যে তার নেই।

আমার এই বিচ্যুতির ভয় আছে। কারণ দুনিয়ার কাছে জবাব চাইতে আমার ভয় লাগে। ভয় লাগে, নিজেকে দৃষ্টিশূন্য করতে। আমি অন্ধ হলে, আমার আগামীও যে অন্তঃসারশূন্যই হবে।  ফলে আমার জন্য যেটুকু কাজ বরাদ্দ রয়েছে তাই করে যেতে চাই। আমার ঈশ্বর যেন সেটুকু শক্তি দেন আমাকে। আমার দৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখেন, যেন সর্বদা সচেতন থাকি ছানির হাত থেকে।

আমার শুভেচ্ছা নিও। ভালো থেকো।

বিতান

OLYMPUS DIGITAL CAMERA
Tags: No tags

Leave a Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *