লকডাউন ১
বেশ কিছু দুশ্চিন্তার সাথেই লকডাউন শুরু হল। তবে একটা আনন্দও ছিল, প্রায় ছ-বছর পর টানা একটা ছুটির ব্যবস্থা হল। এ- ক’বছর রবিবার মানে কী, ভুলেই গিয়েছিলাম। ছুটি কাটাতে যাইনি তা নয়, তবে এতটা লম্বা সময়ের জন্য নয়। আবার সেখানেও কাজ করতে হয়েছে, মাথা-খারাপ-করা সমস্যার সমাধানও। কিন্তু এই ছুটি এমনই যে চাইলেও আমি কাজ করতে পারব না৷ ফলে ২১-দিনের নিশ্চিন্তি। তারপর, দিন হল, রাত এলো, ফেসবুকে নানান ট্রেন্ড চালু হল, সপ্তাখানেক পরেই আবার তা মলিন হয়ে পড়ে রইল ডিজিটাল মেমোরিতে। মোবাইলের অবস্থা আরও করুণ, ক্যামেরার জ্বালা ভোলার নয়। গরম ভাপেও তাকে ছবি তুলতে হচ্ছে খাবারের। সঙ্গে হাজারখানেক ফিল্টার… ফেসবুকে প্রফেশনাল ছবি না দিলে লাইক তেমন আসে না যে! রবি ঠাকুর বোধহয় কয়েক লক্ষবার কান মুলেছেন এই একুশ দিনে, কেন লিখতে গেলেন গানগুলো! সুর? না, তিনিও প্রথমটায় চিনতে পারেননি নিজেরটাই। যাই হোক, এই ক’দিনে বেশ কিছু প্রতিভার জন্ম ও মৃত্যুর স্বাক্ষী থাকলো জুকারবাবুর জু। ওদিকে ভারত নামের দেশে জন্ম নেওয়া মানুষগুলো ক্রমশ নিজেদের পরিচয় পালটাবার তালিম নিতে শুরু করে দিলো। তারা আর কোনোদিনই নিজের নামের আগে শ্রী বা শ্রীমতী লিখবে না, লিখবে ‘পরিযায়ী’।
হঠাৎ, এক রাতে বাসস্ট্যান্ড ভরে উঠল হাজার হাজার ‘পরিযায়ী শ্রমিকে’।
লকডাউন ২
বাংলা বেশ কিছুদিন নিশ্চিন্তে ছিল। কারণ, প্রচুর সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের ইতিমধ্যেই উদ্বোধন করেছিলেন রাজ্যের প্রধান। ফলে রোগী বেশি হলেও চাপ নেওয়ার দরকার ছিল না৷ কিন্তু… ফাঁকা মাঠকে ইট দিয়ে ঘিরে রং করালেই যে সেটা সুপার কেন সাধারণ চিকিৎসারও কেন্দ্র হয়ে ওঠে না, তা আন্দাজ করে উঠতে পারেননি মাননীয়া। আসলে চিকিৎসাবিভ্রাটের খবর আমাদের দেশে খবরের কাগজে পঞ্চম পেজে ছাপা হয়। পরের দিন সেখানেই নতুন রান্নার রেসিপি আসে। এই লকডাউন না হলে, আর প্রথম সারির সংবাদ মাধ্যমের সাংবাদিকবাবুর বাড়ির লোক চিকিৎসাবিভ্রাটে না পড়লে তারা জানতেও পারতেন না ভারতীয় সংবিধানের প্রাথমিক নাগরিক পরিষেবাগুলোকেই রাষ্ট্র অগ্রাহ্য করেছেন এবং বেসরকারিকরণ করেছেন। এই ভয়ঙ্কর সময়ে কোনো কোনো আঞ্চলিক প্রধান তা মেনে নিলেও রোগের প্রতিরোধ করতে যাদের ওপর ভরসা রেখেছেন তারাও সত্তর বছরের জং ঝেড়ে খাড়া হয়ে উঠতে পারেননি। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী তো প্রকাশ্যেই বললেন স্বাধীনতার সত্তর বছরে আমরা স্বাস্থ্যে ‘ইনভেস্টমেন্ট’ করিনি। বেশ হাততালি পেয়েছিলেন এই বক্তব্যে।
প্রথমে আমার মনে হয়েছিল ‘ইনভেস্টমেন্ট’ বেশ আপত্তিকর শব্দ। পরে মনে হল, না, ঠিকই বলেছেন। রাষ্ট্রের কাছে তো আমরা এক-একটি ইনভেস্টমেন্ট। আপনি হয়তো আপত্তি তুলবেন, আমরা আবার কেন? ভেবে দেখুন, এই দেশের প্রতিটি মানুষ পরোক্ষে তো রাষ্ট্রের জন্যই মজুরি করছে। না-হলে রাষ্ট্রের যন্ত্র চলে কীভাবে? এই চালিকা শক্তি অর্থনীতিতে ট্যাক্স নামে বিখ্যাত। এবার কথা হচ্ছে, ট্যাক্স কি আমরা সকলেই দিই? বাজেটে যে ছাড় দেওয়া হয় তা তো কেবল কিছু উঁচু শ্রেনীর জন্যই, তাদের কাছাকাছি ইনকাম ক’জন করতে পারেন এই সমাজে? তাহলে আমি বলব, আপনি ভুল করছেন, প্রতিটি ক্রয়েই আপনি-আমি ট্যাক্স দিই, তা একসঙ্গে জমা পড়ে সরকারি কোষাগারে, তা থেকেই রাষ্ট্রের ‘নিরাপত্তা’ ও ‘বিকাশ’-এর নামে হাজার-হাজার-কোটি টাকা ব্যয় হয়। যে-কারণে আজ বুদ্ধিমান অর্থনীতিবিদরা চিন্তিত নিম্ন-আর্থিক সমাজের ক্রয়-ক্ষমতা বাড়াবার জন্য।সরকারও ভেবেছেন। ছ-মাসের বিনামূল্যে রেশন দেওয়ার ঘোষণা এবং বন্টন শুরু হয়ে গেল বঙ্গে। ওদিকে বাকি দেশ হাঁটতে শুরু করল। ঘরে ফেরার জন্য। না, এই যাত্রায় কেউ গায়নি ‘আমি গাই ঘরে ফেরার গান…’ ঠিক কত মানুষ ঘরে ফিরছেন তার হিসেব কেউ জানত না তখনো। আসলে কত কত মানুষ এই রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে বয়ে নিয়ে যায় তার হিসেব রাখার প্রয়োজনই-বা কোথায়? গাড়ির চাকার দিকে চোখ তখনই পড়ে যখন তা অচল হয়। না-হলে কেবল প্রেশার মেপেই চলে যায় এই বিশাল রাষ্ট্রব্যবস্থা।
দরদও খানিক পরিযায়ী।
চলবে…
[…] প্রথম পর্ব পড়তে ক্লিক করুন চলবে… […]