একবার আমাদের স্কুলের বাংলা স্যর হঠাৎ করে ক্লাস শেষ করে বিশাল ব্ল্যাকবোর্ডে লিখে দিয়ে গেলেন, “মনকে চারিদিক থেকে উদ্বোধিত করো।’’ উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র হওয়ায় ‘উদ্বোধিত’ শব্দের মানেটা জানতাম। কিন্তু পুরো বাক্যের অর্থ মাথার উপর দিয়ে বাউন্স করেছিলো। লাইনটা পড়ে প্রথম রিঅ্যাকশান ছিলো, আমার মনতো চারিদিক থেকেই খোলা, কই দেওয়াল তো দেখি না! এইতো, গহরস্যার যখন পড়িয়ে গেলেন মেঘনাদ বধ কাব্যে রাবণের পিতৃরূপ তাও মনে ঢুকল, আবার তপন বাবুর জটিল ইনরগ্যানিক কেমিস্ট্রির ক্যালকুলেশন গুলোও। তারও মাঝে মনে ঢুকে গেলো গতকাল কোন একবন্ধুর নতুন প্রেমিকা পাওয়ার (পড়ুন পটানো) গল্পও। এতদ্বারা প্রমাণিত যে আমার মন চারিদিক থেকে ‘উদ্বোধিত’!
তারপর কয়েকমাস কাটিয়েই কলেজ। গোলটা বাঁধলও তখনই। কলেজ ক্যান্টিনে একদল দাড়ি- গোঁফ ওয়ালা ছেলে বিক্রি করলো একখানা পত্রিকা। প্রথম পাতায় নজরুলের কোটেশন, যা আমার মত করে সরল করে নিলে হয়, একদল মানুষ এসে মন্দির ভাঙল, তখন কালি এসে বাঁধা দিলে না, এমনকি আকাশ থেকে কোনও বজ্রও নেমে এলো না এই অকল্যাণের মাথায়। আবার কিছু মানুষ যখন মসজিদ ভাঙলেন আল্লাহও যথারীতি চুপ। এই কথাটা আমাকে খুব চঞ্চল করে তুললো। আমিও বিপদে ঈশ্বর জপেছি তার কয়েক মাস আগেই। ‘ঠাকুর অঙ্কটা উৎরে দাও, তোমার পুজো দেবো!’ উৎরে গিয়ে, মহান ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিয়েছি, কথা রাখতে সক্কালবেলা দক্ষিণেশ্বর গেছি পুজো দিতে। তবে? যে মহাশক্তি আমার সামান্য অঙ্কের সমস্যা মীমাংসা করে দিতে পারেন নিমেষে, সে কিনা তার নিজের অতবড় অনিষ্ট মেনে নেয় বিনা বাঁধায়। এ বোধ তো কখনো উদ্বোধিত হয়নি আমার মনের মধ্যে? তবে কি একটা বড়সড় দেওয়াল থেকে গেছে মনের মাঝখান বরাবর? খোঁজ খোঁজ রব পড়ে গেলো সমস্ত মন জুড়ে। মনস্তাত্ত্বিকেরা বলেন নিজেকে চিনতে নিজের আয়নার সামনে দাঁড়াতে হয়। আমি আমার আয়না হিসেবে বেছে নিলাম শব্দ। শব্দ আমার মধ্যে এক এমন জাল তৈরি করল, তার ফাঁস আজও আলগা হলো না। যাইহোক, শব্দ যে কেবলই জাল বুনলো না, সে নিজেকে নিজের সামনে দাঁড় করালো উলঙ্গ করে। এত দেওয়াল, এত দেওয়াল নিজের মধ্যে!! আর সেটা নিয়েই এত গর্ব? এমন সাহিত্যসেবক হয়ে লাভ কি? যে শব্দ ইতিহাসের প্রতিটি পাতাকে লেখে তার সাথে প্রবঞ্চনা? যে বিশালের মধ্যে এসে আমার এত অহংকার, তার সাথে শঠতা… না এ অসম্ভব। এরপর এক প্রবল বিশ্বাস জন্মালো যে শব্দ আলো দেখায় না, উদ্ভাবিত করে না আমার মনকে তা মিথ্যে। কারণ?
আরও একটা গল্প বলি, শুনুন। সালটা ২০১৩, আমার মনে এক অদ্ভুত রোগ দেখা দিলো। যার নাম ‘মন খারাপ’। রোজ সকালে চোখ মেলেই আমি আমার সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দিতাম, আরও একটা দিন আমাকে বেঁচে থাকবার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। সারাদিন সমস্ত কিছুকে দুচোখ ভরে দেখতাম। যদি কাল না আর দেখা হয় এদেরকে! এক মহা বেদনা আমাকে মোচড় দিয়ে যেতো সঙ্গে সঙ্গে। এমনই একদিন সকালে উঠে ভাবলাম আজ একটু আমার জমানো বইগুলোকে দেখে নেওয়া যাক। হাতের সামনে পাওয়া বইটা উলটে পালটে দেখতে দেখতে চোখ আটকালো একটা চ্যাপ্টারে, নাম “মৃত্যু ও অমৃত”। লেখক স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। আমাদের এই চলে যাওয়ার ‘বেদনা’ সম্পর্কে বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, আসলে আমরা আমাদের চারিপাশে কেবলমাত্র ‘আপনাকেই’ স্থাপনা করি। আর যখন ওই ‘চলে যাওয়ার’ বা ‘শেষ হওয়ার’ বেদনা এসে চেপে ধরে তখনই আমাদের মনটা খালি বলে ওঠে ‘এটা আমার, এটা আমার তৈরি করা, আর একে ছেড়েই আমাকে চলে যেতে হবে?’ ‘আসলে আমরা চারিপাশে কেবল আপনাকেই স্থাপনা করে গেছি’।
স্থাপনা করা কি তাহলে খারাপ? না, আসলে এই স্থাপনা আমাদের অহংকার। এই স্থাপনা আমাদের মনকে কোথাও উদ্বোধিত করে না। আর সাহিত্যচর্চা আমাদের এই স্থাপনার বাইরে নিয়ে যায়। কিন্তু মাঝেমাঝেই আজকাল পাঠক প্রশ্ন করেন, সত্যিই কি তাই? “আপনারা আজকের সাহিত্যকর্মীরা এই স্থাপনার বাইরে এসে সাহিত্য লেখেন?” এক পাঠকের এই প্রশ্নের সামনে আমি খানিক বিচলিতই হয়ে পড়ি। না, আমরা সত্যি সেটা প্র্যাকটিস করি না। এ নিয়ে, আবারও একটা ঘটনা বলি, একবার আমার এক কবি বন্ধুর সাথে বেশকিছুদিন ধরেই বিবাদ চলছিল, শিল্পীর কাজ ও তার জীবন এক হয় কি না তা নিয়ে। আমার বন্ধুর বক্তব্য এক নাও হতে পারে। সে যেটুকু সময় শিল্পকর্মের সাথে থাকছে সেটাই তার সততা। এর বাইরে এসে সে যদি তার জীবনকে কাজের (কাজ এখানে শিল্পীর দর্শন) বাইরে নিয়ে চলে যায়, সেই স্বাধীনতা সে নিতেই পারে। এ কথা আমার বিশ্বাস হলো না। শেষমেশ আমরা স্থির করলাম, এই বিবাদের মীমাংসা করবো কবি শঙ্খ ঘোষের কাছে। স্যরের কাছে এক রোবাবর সক্কালবেলা গিয়ে উপস্থিত হলাম। স্যর স্মিত হেসে ব্যপারটা উপস্থাপিত করলেন উপস্থিত আরও কিছু অধ্যাপক ও শিল্পীদের মধ্যে। তারাও এককথায় মেনে নিলেন যে আমার বন্ধুর কথাই ঠিক। যুক্তি দিলেন, শিল্পে যা সত্যি তা বাস্তবিক জীবনে প্রয়োগ করা খুব কঠিন। আজকের দিনকালে এভাবে চলা যায় নাকি! সব শুনে স্যার যথারীতি আবার স্মিত হাসলেন, বললেন, শিল্প ও জীবন এক হওয়াটাই কাম্য তবে সবাই তা পারেন না। স্যর বিশদে কিছু বললেন না। বলবার কথাও নয়। শম্ভু মিত্র বলতেন, কেউ সবটা বলে দেবে না। বলবে এইটুকু, বুঝে নিতে হবে এতোটা। কিন্তু মূর্খ আমি। ছুটলাম সুপ্রীতি মুখোপাধ্যায়-এর কাছে। টালিগঞ্জ মোরে সবে সন্ধ্যে নেমেছে। সুপ্রীতিকাকু, প্রশ্ন শুনে একটু থমকালেন। ধীরে বললেন, সেই চেষ্টাই তো করছি রে। তবে এখনো পেরে উঠিনি। বড় কঠিন এ পথ। সন্ধ্যের আবছা আলোয় যেন কাকুর চোখের কোনটা একটু চকচক করে উঠতে দেখলাম।
পথ কঠিন। হ্যাঁ তা বটে। তবে কিনা এই কঠিনের সাধনাই মানুষের। মানুষ কখনই কাছের পাওয়া কে নিয়ে চিন্তিত ছিলো না। থাকলে সে কখনো আগুন জ্বালতো না। ধাতু গলিয়ে তৈরি করতো না হাতিয়ার। বানাতো না সভ্যতা। আর আমাদের শিল্প-সাহিত্য সেই সভ্যতার দলিল। দুরকে কাছে পাওয়ার এক মাধ্যম। কিছু ভুল বললাম। ও হ্যাঁ, ভুল করছি। আমরা শিখেছি শিল্প-সাহিত্য কেবল বিনোদনের এক মাধ্যম। আমরা শিল্পী সাহিত্যিকেরা আসলে পাফরমিং আর্টিস্ট। যেমন ধরুন শাহরুখ খান। আপনাদের খুব একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করছি, আপনারা কেউ প্রেম করেন? প্রেমিকার সাথে জাস্ট একটা রোমান্টিক মুহূর্ত ভাগ করে নেওয়ার জন্য সুইজারল্যান্ড গেছেন, নিদেন পক্ষে মেরিন ড্রাইভ। শাহরুখ খান জান। সিনেমায়। হতে পারেন তিনি সিনেমায় গ্যারেজের ম্যাকানিক বা চাকরী প্রার্থী। তাতে ক্ষতি কি। তিনি যে আমাদের লার্জার দ্যান লাইফের হিরো। এই ল্যার্জার দ্যান লাইফের মানেটা কি? এর মানে, আমার আপনার দিন-দৈন্যতার থেকে বহু ক্রোশ দুরের একটা শহর। আসলে এটা একটা ইচ্ছে। যেটা আপনার বা আমারও করতে ইচ্ছে করবে। করেও ফেলি। অহেতুক বিতণ্ডা প্রিয় বুদ্ধিজীবীরা যাকে বলেন পন্যায়ন, আর মিডিয়া বলে মশলা!
দারুন বললে <3
[…] Source: নিজের পানে চাইতে মানা! (প্রথম পর্ব) […]
সুন্দর পথ চলা শুরু করলি। পুরোনো দিনের অনেক কথা আবার শোনা যাবে তোর ব্লগ থেকে।
Khub valo likhechho. Matamat niye bolchhi na. Se ekekjoner ekekrakam hote pare. Kinu bisay r uposthapona chamothkar.