একদিনের বন্ধ নয়, কেন্দ্র বলছে ২১ দিন। তার মধ্যে তিনদিন কেটে গেছে। অনেকেই মেনে চলছেন, আবার অনেকেই ভাঙনের খেলায় মেতেছেন। তারা নাকি ঘুরে বেড়াচ্ছেন, চা খাচ্ছেন, বাজারে গিয়ে অকারণ ভিড় জমাচ্ছেন। মিমও দেখলাম। আর সাংবাদিকদের ক্যামেরা তো আছেই। আমার ফেসবুক প্রতিবেশিরা এদের মর্কট, আহাম্মক, বেয়াক্কেল ইত্যাদি ভূষণ দিয়েছেন, দিয়ে চলেছেন। তা এসব মিথ্যেও নয়। স্যোশাল ডিসট্যান্সিং বা আইসোলেসন ছাড়া এই মহামারির চিকিৎসাই বা কী আছে! ফলে নিয়ম ভাঙলেই লাঠিপেটার যে নিদান আমাদের ভার্চুয়াল আদালত দিয়েছিলেন, তা কাজে করে দেখাচ্ছেন রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা। মারের দাগও দেখলাম বেশ কিছু ছবিতে। ভয় হল। যদি ওষুধ আনতে গিয়ে একই হাল আমারও হয়! আসলে মাসের ওষুধ যেগুলো আমার এবং আমার পরিবারের জন্য কিনতে হয়, প্রতিটা নামই আমার প্রায় মুখস্ত। ফলে অন্য দিন প্রেসক্রিপশন নিয়ে যেতে হয় না। এবারও যদি নিয়ে না বেরোই তাহলে আমার চামড়ার ওপর যে কালচে-লাল দাগটা পড়বে, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখতে বেশ খারাপ লাগবে। লজ্জাও লাগবে। ফলে শেষ আটচল্লিশ ঘণ্টা বাইরে বেরোইনি। আমার নিজের একটা ওষুধ লাগবে, তবু ভয় পাচ্ছি। রাষ্ট্রের দাগ খুব সহজে মিলিয়ে যায় না।
২৪ মার্চ ২০২০, রাত আটটায় ঘোষণা হল সমস্ত দেশ জুড়ে লক-ডাউন। তার পনেরো মিনিট পরেই বাজার থেকে ফোন এলো ‘বিতান, চটপট চলে এসো। কাল থেকে কিন্তু আর কিছুই পাওয়া যাবে না।’ কিন্তু জরুরি পরিষেবা যে এই বন্ধের বাইরে? ‘মহাজন বলে দিয়েছে আর মাল তুলবে না।’ আমি যখন বাজারে গিয়ে পৌঁছোলাম রাত ন-টা কুড়ি বেজেছে সবে। আরও পনেরো মিনিট অপেক্ষা করতে হল বাজারের মধ্যে ঢুকতে। এত এত মাথা আগে কখনও দেখিনি আমারই পরিচিত বাজারে। থলি ভরে নেওয়ার যেন হিড়িক পড়ে গেছে। কেউ কেউ বস্তা ভরে বাড়ি ফিরছেন। আমার লক্ষ কিছু সবজি আর মাছ। সেদিন হাজার তিনেকের বাজার করেছি। প্রায় দেড়গুণ দামে। এখানে একটা বাক্যে লেখাই যায় অসাধু ব্যবসায়ীদের মুণ্ডপাত। কিন্তু…
এই কিন্তুতেই গত দু-দিন আটকে আছি আমি। ভালো করে লক্ষ করে দেখলুম ভিড় সবচেয়ে বেশি বাজার ও দোকানে। হ্যাঁ, সংক্রমণের ভয় বুকে করেই মানুষ দাঁড়িয়েছেন লাইনে। এক মিটার? আমাদের মতো এক চিলিতে বাজারে যা শুধুই এক দিবাস্বপ্ন। অনলাইন স্টোর যেমন বিগবাসকেট বন্ধ। তাদের বক্তব্য, লোকাল প্রশাসনের বিধিনিষেধের জন্য আপাতত সাপলাই বন্ধ। তারা প্রশাসনের সাথে কথা বলছেন। দ্রুত তাদের সার্ভিস খোলা হবে। এই নোটিস প্রায় চার দিন ধরে ঝুলে আছে। তাহলে কি আমার সেই পরিচিত বাজারওয়ালার কথাই সত্যি, মহাজন মাল আর তুলবে না। সরকারি নির্দেশ অমান্য? গতকাল বিকেলে মুখ্যমন্ত্রীর প্রেস কনফারেন্সেও কিন্তু সেই সুর, ‘বন্ধ করছেন কেন? অত্যাবশ্যকীয় সামগ্রীকে আটকানো যাবে না।’ তারপর আজও শোনা গেলো পুলিশ আটকে রেখেছে সবজির ট্রাক। মানুষজন পাগলের মতো ভাবছে, আজ তো হল, কাল কী হবে, একুশ দিনের মাথায় কী হবে, লক-ডাউনের সময় যদি আরও বাড়ে? সংক্রমণে না হলেও, খিদেতে মৃত্যু নিশ্চিত সত্তর শতাংশ ভারতবাসীর। নাহ, এত ভাবনার দরকার নেই। প্যাকেজ এসেছে। এবার সব্বাই ভালো থাকবে।
আচ্ছা বুকে হাত দিয়ে বলুন তো আপনার ভয় করছে না? কিসের ভয় বলুন তো? সংক্রমণের নাকি না খেতে পাওয়ার? মানুষ মহামারির এমন লক-ডাউন না দেখলেও খিদের মহামারি দেখেছে। আমাদের প্রজন্মও দেখেনি মহামারি, তবে জিনে ঢুকে আছে তার ভয়। সেই ভয় থেকেই এই নির্দেশের প্রতি অবজ্ঞা। আসলে এই ‘মানি না লক-ডাউন’ ভাবটা মানুষের রাষ্ট্রের প্রতি চরম অবিশ্বাসের ফল। স্বাধীনতার পর এত এত বছর পরেও মানুষ যা শোনে তা পায় না। রেশনে আসা চাল থেকে চিনি, সরকারি চেক থেকে মরে যাওয়ার প্রমাণপত্র — হাতে কিছু না গুঁজলে পাওয়া যায় না। যারা খানিক রাজনীতির খবর রাখেন তারা একটি শব্দের সাথে পরিচিত, কোরাপশন। কোরাপশন আসলে আর একটি প্যারালাল রাষ্ট্র। তার নিজেস্ব সংবিধান আছে, বিচারব্যবস্থা আছে, শাস্তি আছে, ফাইন আছে… এগুলোও আমার আপনার কাছে নতুন কিছু নয়।
মাইক্রোস্কোপের নীচে ফেললে দেখবেন এমন ছোটো ছোটো রাষ্ট্র দিয়েই এই বিশাল সিস্টেমের জন্ম। ফলাফল আমরা গেল সত্তর বছরে কেবল শুনতে অভ্যস্ত, দেখতে নই। রাষ্ট্র বলেছে, বাজারে আমরা সস্তায় পেঁয়াজ বিক্রি করছি। আপনারা ভয় পাবেন না। বাজার থেকে এই মানুষগুলোই পেঁয়াজ কিনে আনছেন বাজার নামক রাষ্ট্রের দামে। যার সঙ্গে টিভি, রাষ্ট্রের রেটকার্ড মেলেনি। আমরা নিশ্চিন্তে দুটো মুখে দিয়ে ভেবেছি, ও এমন হয়। যা রটে তা কি আর ঘটে? দেশে খবর ছড়ায় এত এত সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল হল। তারপর আমরা হয় পাড়ি দিই ভিন রাজ্যে, না হলে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতাল। যার অফিশিয়াল নাম ‘রেফারেল’। মৌখিক নাম ‘বেড নেই’। তাহলে নতুন হাসপাতাল? পশ্চিমবঙ্গের পাঁচটি নতুন ফুললি ফাংশানাল হাসপাতালের নাম বলুন, এবারের পিএসসি-তে এই প্রশ্ন করাই যেতে পারে। ওহ, এই আপদের দিনে রাজনীতি করবেন না।
হাততালি দিয়েছিলেন? আরে ২২ মার্চ, বিকেল পাঁচটায়! কাসর-ঘণ্টা? এতে কিন্তু ভাইরাস মারা যায়। আমি কী জানি? আরে গুগুল করুন। শশিজি (থারুর) বলছেন মরে না। আইটি সেল বলছে মন্দিরের মাথায় ঘণ্টা লাগাবার এটাও একটা বিজ্ঞানসন্মত কারণ। মোদিজি বলছেন আমি এসব কিছুই জানি না আপনারা কেবল যারা সেবা করছেন তাদের ভালোবাসা দিন। তারপর আমি চুপিচুপি বুঝে নেব এখন ভোট হলে আমার টিআরপি কেমন? প্রধানমন্ত্রীর আবার টিআরপি, তা দাদা পিএম না মেগা সিরিয়াল! ও আপনি বুঝবেন না মোদিজিরও একটা প্রশান্ত কিশোর আছে। তাহলে যারা জীবনপন করে খাটছেন, সেবা করছেন রুগীদের তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখাব না? আহা আমি কি তাই বললাম? এক কাজ করুন না, এরপর হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তারকে চোর বলে গালি দেওয়া বন্ধ করুন। পেটানো তো নয়ই। উলটে গবেষণা করুন হাসপাতালের কেন এই হাল, কেন সমস্যা হলেই সরকার বেসরকারি হাসপাতালের সাহায্য চান, কেন এই অমিতাভ বচ্চন থেকে ঋষি কাপুর, অমিত শাহ থেকে অক্ষয় কুমার অসুস্থ হলেই লন্ডন বা নিউ ইয়র্ক পাড়ি দেন, আর আপনি ভেলোর বা চেন্নাই। আর যদি উত্তর না পান প্রশ্ন করুন তাদের, যারা ঘরবন্দি অবস্থায় দেশের সাধারণ মানুষের উদ্দ্যেশে ভিডিও বার্তায় বলছেন, হ্যাভ ইউ লস্ট ইট?
বিতান চক্রবর্তী