‘আসছি!’ বলে চটিটা পায়ে গলালেই গলার কাছে একটা কান্না চেপে বসে। তুমি বলবে অকারণ! তবু কান্না এসব যুক্তি মানবে কেন? সে গলার কাছে অবরোধ করেই রাখে। বার কয়েক বেশ জোরে খুক খুক করতেই হয়, না হলে সে পথ ছাড়বে না। আসলে তারও তেমন দোষ নেই, সে বেচারাও করবে কি! তোমাকে ছেড়ে চলে যেতে হবে এই ভাবনাই মনের সমস্ত কিছু দিয়ে আপনা থেকেই অবরোধ করতে থাকে। সকালের তোমার আঁচলের সেই, সর্ষের-তেল-হলুদ-নুন মেশানো গন্ধটাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য তো এখনও প্রস্তুত নই আমি! রাতে আধো ঘুমের ঘোরে মুখের সামনে মুখ এনে আমাকে অ-নেশাতুর প্রমাণ করবার স্পর্শ ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি সেরে ওঠা কঠিন, সে তোমার থেকে কে বেশি জানবে মা! তাই বিদ্রোহ করে ওঠে মন, অবরোধ করে কান্না। তারপর ‘তাড়াতাড়ি আসিস’ শব্দ দুটো শুনলেই অবরোধ শিথিল হয়। ফিরে আসি, তবু প্রতিদিন এই অবরোধ আর শেষে শব্দের সাথে বনিবনা করে অবরোধ তুলে নেওয়ার খেলা নেহাত খারাপ লাগে না! আনন্দ হয়। না, না আনন্দ নয় তৃপ্তি দেয়। তোমার, আমার মধ্যে থেকে যাওয়াটা আমাকে আরাম দেয়।
আসলে আমাদের অস্তিত্ব যে একলা হয় না। কত কত যুগ মিলেমিশে থেকে যায় আমার অস্তিত্বে। এই সমগ্রকে বংশ বলে ইতিহাস, আমি আলাদা করে, মা বাবা বলি। হতে পারে এই ব্লেন্ড সমান নয় আমার মধ্যে, তাই তোমাকেই সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে দেখি। হয়ত দেখতেই চাই! হয়ে উঠতে চাই তোমার মতই! তোমার মনে আছে ছেলেবেলায় খুব বায়না করলেই তুমি রেগে গম্ভীর হয়ে বলতে ‘না বলেছি যখন পাবে না’, তারপর কোনও একদিন বিকেলে আচমকা চমকে দিয়ে পাইয়ে দিতে। আচ্ছা এটায় কি তুমি তৃপ্তি পেতে? আজকাল আমিও করি এই ট্রিকটা। আমি ছেলেবেলা খুঁজে পাই না বিশ্বাস করো, আমি সে সময় তুমি হয়ে ওঠার আরাম পাই।
তোমায় কোনও দিন কাজল পড়তে দেখিনি। আসলে কাজল পড়া থাকলে কান্না ভালো বোঝা যায়। তাই কেউ কোনও দিন বোঝেনি সারাদিন সমস্ত কাজের মাঝে হঠাৎ হঠাৎ ডুকরে উঠেছ তুমি! রাতেও ডুকরে উঠলে আজ আর মনে পড়ে না বাবার আদর পেতে কিনা! বাবাকে বরাবর মনে হয়েছে নীলকণ্ঠ। আকণ্ঠ বিষ সহ্য করবার আধার। শুধু সেই সেবার আধা খাওয়া ভাতের থালায় যে ভাবে বিদ্রোহ করেছিলো তোমার অপমানে, মনে পড়ে তোমার? সেদিন আমার কিশোর বেলায় প্রথম মনে হয়েছিলো বাবা তোমাকে খুব ভালোবাসে! তবে সে ভালোবাসা পাহাড়ের মত, আগোল বড়, নরম মাটি নেই। কান্না নেই। যেদিন হাসপাতালে তোমার অপারেশন হবে ফোনের ওপারে ‘তোমার মা কেমন আছে’র স্বরটা আমাকে ঝর্নার কথা মনে পড়ালো। তবু কিন্তু আমি সেদিন ছেড়ে কথা বলিনি বাবাকে। দায়িত্ব কর্তব্যের পাঠ ভালোই শিখিয়ে দিয়েছিলাম। চুপ করে ছিলো বাবা, তুমি সবে যন্ত্রণা ভোলার ওষুধ খেয়েছো, মৃদু স্বরেই বললে, ‘আঃ চুপ কর!’ আমিও অবজ্ঞায় চুপ করে গিয়েছিলাম। তুমি বাবা দুজনেই হয়ত সেদিন অপমানিত হয়েছিলে, কিন্তু কোনও উত্তর দাওনি। কোনও কালেই কি দিয়েছো কোনও জবাব? তাই আজকাল তোমাদের সমস্ত নিরুত্তর অপমানের দাগ কুঁচকে যাওয়া চামড়ার নিচে কালশিটে আলপনা হয়ে জেগে থাকে।
তাও আমি বাবা হতে চাইনি কোনও দিন। আমি কেবল তোমাকেই গুলে নিতে চেয়েছি নিজের মধ্যে। তোমার মত চঞ্চল হয়ে উঠতে চেয়েছি কেউ অসুস্থ হলেই, বাবার মত বাইরে থেকে উদাস হয়ে যেতে চাই না, তোমার মত স্নেহ মাখিয়ে দিতে চেয়েছি যে কোনও সন্তান (এর মত কাউ)-কে। আমার প্রতিটি আঙুলকে বিশেষ করে শেখাতে চেয়েছি সেই স্পর্শকে ধরে রাখতে, যা কপালে ছোঁয়ালেই বৃষ্টির আরাম পায়! নিজের চামড়ার ধমনীকে প্রসস্থ করতে চেয়েছি যাতে আরও, আরও অপমান এসে মিশে যেতে পারে, জমে থাকতে পারে ততক্ষণ যতক্ষণ না পর্যন্ত তা আলপনা হয়ে যায়!
কিন্তু যখন পায়ে চটি গলিয়ে বলি ‘চললাম’, কেন যে কান্নাটা গলা চেপে ধরে…? তবে কি মিশিয়ে নিতে পারিনি তোমাকে? না হলে এত ভয় কেন? কেন বাথরুমে কল ছেড়ে দিয়ে কেঁদে ফেলি? কেন রক্তে অপমান গুলতে গুলতেও উথলে উঠে আসতে চায়? কেন আমার সমস্ত স্নেহ ঢেলে দেওয়ার পর কারও মনে হয় ‘কিছুই তো পেলুম না’। কেন এ সংসারে নদী আর পলির মত মিলে যেতে গিয়ে দেখি সংসারের আড় বরাবর পাহাড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছি!
আসলে কি জানো মা, তুমি আমার ইচ্ছে, কিন্তু এ জন্ম আমার পিতার। পাথর ফাটিয়ে ঝর্ণা না এলে আমায় আর্দ্র হতে নেই।