প্রিয় কিরীটীদা,
সম্পাদক মহাশয় আদেশ করেছেন; শুনলাম আমাকেও লিখতে হবে তোমাকে নিয়ে। তোমাকে নিয়ে মানে? তুমি লোকটাকে নিয়ে, নাকি লোকটার লেখা নিয়ে! দু’বছর ধরে চেনা লোককে নিয়ে কী লিখি? দু’বছরে আড়াল সরে কি? না, সরে না। যদিও এ আমার বিশ্বাস। আর সরবেই বা কেন? আড়াল সরে গেলে, যে চমক থাকে জীবনের পরতে-পরতে, তাই তো ফসকে যাবে। জীবনে চমক থামলে চলবে কেন! তার চেয়ে দু’বছরে লেখককে চেনা সহজ, শব্দে আড়াল কিম্বা লুকিয়ে পড়াটা কঠিন, অন্তত সচেতন পাঠকের কাছে তো বটেই। ফলে লেখার কথা বলাই ভালো। এবার তুমি প্রশ্ন করতে পারো, “আরে তা-বলে চিঠি! এ তো আমার ফরমায়েশ নয়!” না, তা নয়, তুমি কেবল বার্তাবাহক, তবু কথাগুলো তোমার সাথেই সরাসরি হওয়া ভালো। কারণ, পাঠক খুব কমই এমন সুযোগ পায় যখন সে সরাসরি মনের কথাটুকু বলে ফেলতে পারে লেখকের কাছে… অকপটে।
আমি তোমার শুরুর লেখাগুলোকে স্পাইডারম্যানীয় কায়দায় ডিঙিয়ে এসে আজকের “রিফ্লেকশনস অন স্যালভেশন” নিয়ে শুরু করি কথা। কারণ, এর তৈরির প্রক্রিয়ার অন্যতম সাক্ষী কেবল আমিই হয়ত। আর সাথে ওই লেখাগুলোকে বাংলায় অনুবাদের চেষ্টা করেছিলাম বলে। না, না, ভয় নেই জ্ঞান দেবো না, ঢাকও পেটাবো না। আসলে, কিছুদিন আগে শুনলাম একজন পণ্ডিত-মানুষ বলছেন, আজকের এই ধর্মবিরূপতার যুগে (সাথে ধর্মকে নিয়ে সন্ত্রাস তৈরির পরিবেশে) তুমি সাহস দেখিয়েছ আবার ধর্মে ফিরে যেতে। দ্যাখো, আমি বড় মূর্খ মানুষ, তুমি জানো; আমি এই কথাটার অর্থ ঠিক বুঝতে পারিনি। আমি খানিক কথাটার চমকে আছি। নানা প্রশ্ন আসছে মনে; যেমন ধরো, তাহলে কি না-যাওয়াই শ্রেয় আমাদের শিকরের কাছে; ধর্ম কেবলই উপাচার, বা কেনই বা আজ এই ট্রেন্ড এসেছে ‘আমি নাস্তিক’ টাইপের, নাকি এখনও খানিক রস নেওয়া বাকি থেকে গেছে আমাদের আমাদেরই ধর্ম থেকে? আসলে আমি একে ধর্ম বলতে চাই না। এ এক জোট; মন এবং মননের জোট। আর এই জোট আমাদের অর্জন করতে হয়। আর হয়ত এই অর্জন করবার উপাসনাকেই ধর্ম বলো তোমরা। আর উপাসনা তো একক নয়, তার সাথে মিলেমিশে থাকে আমাদের কাম, বাসনা, লোভ। আসলে লোভই। পৃথিবীর সমস্তটাকে অধিকার করবার লোভ। অন্তরে অধিকার করার কথা বলছি না। এই অধিকার ক্ষমতার স্বাদ দেয়। আর যা কিছু আমরা অন্তরে অধিকার করি সে জোর দেয়। তাই অন্তর বাহিরের লড়াই থামে না। থামবেই বা কেন? লোভ সারাদিন কেবল ক্ষিপ্র হয়ে থাকে পাওয়া-কে নিয়ে, আর জোর মুচকি হেসে বলে, “ও আমি এমনিই পাবো, আমাকে হাত বাড়িয়ে, পেশি ফুলিয়ে পেতে হবে না”। তখন যে তৃষ্ণায় ফেটে যাবেই লোভ। তাই তো “রিফ্লেকশনস অন স্যালভেশন”। প্রশ্নের স্তরে-স্তরে প্রশ্ন, কেবল নিজেকেই এই প্রশ্ন। হ্যাঁ, আমি জোর দিয়েই বলছি আজ, ওই প্রশ্নগুলো কেবল নিজের জন্যই ছিল, পাঠক দূরের তারা। এ বই কেবল নিজেকেই পরতে-পরতে খুলে নতুন করে আবিষ্কার করা, এতে কোনও ধর্ম-বিরোধ নেই। এই বইয়ের প্রতিটি শব্দ অতিক্রম করলে, আমাদের শান্ত করবে, মনে করিয়ে দেবে কে আমি, কি করতে এসেছি। আর এই অশান্ত সময়ে শান্ত থাকাটাই উপাসনা। না, কেবল নিজেকে শান্ত করলেই আমার কাজ শেষ নয়। আমাদের কাজ সমস্ত উত্তপ্ত হৃদয়ের উপর ঠাণ্ডা হাতের তালু-খানা রেখে বলা, “চেতনায় ফিরে এসো। তুমি শান্ত না হলে তোমার ঈশ্বরের কান্না থামে না যে”! কিন্তু এ বলা সহজ, আর করা? সে যে শুনেছি মহামনিষীর কাজ। ব্যস, এটুকু বলেই খালাস আমরা। দায় শেষ আর কি! তাহলে লিখতে এসেছি কেন? ছবি আঁকা কেন এই বিরাট ক্যানভাসে? কেবল স্তুতি পাবে বলে? নাকি, এও এক ক্ষমতায়নের খেলা! কিরীটীদা, আমরাও কি তাহলে সেই পথেই চলবো? জীবন তার নিজস্ব পথ আর ‘শিল্প মহান’ এই শ্লোগান দিয়েই দিন কাটাবো? শব্দ স্থাপনা করা তো আমাদের পূজার ফুল, চিন্তা আমাদের উপাসনা, আর তুমিও তো বল, ভগবানের উপাসনায় কেবল ভালো চাইতে নেই, তাহলে খারাপগুলো যাবে কোথায়? আমরাও তো নীলকণ্ঠ হতে পারি! না হলে তাঁকে পাবো কোথায়? এত এত লোভ দিয়ে তাঁর আসন ভর্তি করে রাখলে তিনি স্থাপিত হবেন কোথায়?
এই দেখো, কথার ভাঁজে অন্য কোন রাস্তায় চলে গেলাম কে জানে? কথা ছিলো, তোমার কাজ নিয়ে কথা বলবো, কিন্তু… বাচালের ধর্ম! তার কেবল এলোমেলো রাস্তা হাঁটাই অভ্যাস। কান না ধরলে সে পথে আসে না! ফিরে আসি তোমার লেখায়। আমার আজও মনে আছে, অফিসে আসছি, হাতে রিফ্লেকশনের কপি, শেষ লেখা-খানা খোলা, চোখ রাস্তায়, রাস্তা আমাকে ছেড়ে পিছনে চলে যাচ্ছে, অনেকটা যেন চাদর টেনে আনার মত, সেই টানেই চলে আসতে থাকে “They say, God dwells within; it is then the mortal exploration of the resort where salvation is largely seen!” ভাবছি, আমি আমার ভাষায় কেমন করে বলি একে! না, না, তখন অনুবাদের চেষ্টার কথা দূরদূরান্তে নেই। আমি কেবল অর্থ বুঝতে চাই, নিজের মতো করে, নিজের ভাষায়। “ঈশ্বরের বাস আমার মধ্যেই”। তাই তো সোহম! তবে কি তাঁকে নিজের মধ্যে খুঁজে পাওয়াই মুক্তি? না, শুধু তা কেন, তিনি সর্বত্র বিরাজ করেন, আসলে তাঁর সাথে যুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়ার নামই মুক্তি বলে মনে হয় আমার। যেমন একটা-একটা ইট জুড়ে মন্দিরের চূড়া হয়, তেমনই এই সংসারের সাথে জুড়ে-জুড়েই সেই চূড়ায় পৌঁছনো সম্ভব, এই সামান্য কথাটুকুই তো বলা সারা বইটা জুড়ে। এই সহজ কথাগুলোই তো বলা দরকার এখন, এই অশান্ত সময়ে। যখন উন্মাদনা, অসহিষ্ণুতা দরজা আটকে দাঁড়িয়ে, এমনই সময়ে সহজে অথচ এক ধাক্কায় তা খুলে ফেলাই তো মুক্তি। এইতো আমার সংস্কৃতি। সহজ, সরল, অবিচল। শুনেছি, একবার রবীন্দ্রনাথ সৃঙ্ঘল (শ্রীলঙ্কা)-এর এক নাচ দেখে ভারি আনন্দ পেয়ে তা ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন ‘চণ্ডালিকায়’। তবে ব্যবহার করবার সময় মূল নাচের উদ্দামতাকে বাদ দিয়ে তার স্নিগ্ধতাকেই রাখলেন। আসলে উদ্দাম যে উন্মাদনায় নিয়ে যায় তা আমাদের ভেতরের জানলাগুলোকে বন্ধ করে। অন্ধকার ফুঁসিয়ে তোলে। জাগিয়ে তোলে বহুকাল আগের অসভ্য জন্তুর গর্জন। নিজের সন্তানও তখন ভোজ্য হয়ে ওঠে।
কিরীটীদা, এসো আমাদের ঈশ্বরের কাছে আজ উপাসনার সময় ওই জানলাগুলোর জন্য আলো চেয়ে নিই। যুক্ত হওয়ার কষ্ট আছে। বহুদিনের বন্ধ দরজা খুলতে গেলে লাগে বৈকি, তবে না খুললে যে আমাদেরও মুক্তি নেই। আর কেবল নিজের মুক্তিও যে মিথ্যে সে তুমি বাবা হয়ে ভালোই জানো।
বিতান
১৭ এপ্রিল, ২০১৭
নিমতা, কলকাতা।