প্রকাশনা এক ‘এলিট’ শিল্প!

আচ্ছা, বই-ব্যবসা বললে আপনার মনে কী আসে? আমার মনে ভেসে ওঠে কলেজ স্ট্রিটের ওপর স্কুলপাঠ্যের সুবিশাল বাজার। ঠিক সংস্কৃত কলেজের বাইরে, জিরো শেপের এলাকাজুড়ে ছোটো ছোটো দোকান, যার সামনে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে বড়ো বড়ো ব্যাগ হাতে জেলার ক্রেতারা। এমনকী, স্কুল-ফেরতা অভিভাবকদের ভিড়ও আপনার চোখ এড়িয়ে যাবে না৷ ছাত্র-ছাত্রীরাও সেই দলে থাকেন৷ কয়েক দশকে যেমন কলেজ স্ট্রিটের বাইরে, বিভিন্ন জেলায় নতুন বইয়ের দোকান খুলেছে, তার চেয়ে কয়েক গুণ দোকান বন্ধও হয়ছে। সেই দোকানগুলো সবটাই যে স্কুলপাঠ্যের দোকান ছিল, তা নয়। অন্য বইয়ের দোকানও বন্ধ হয়ে তারা স্কুলপাঠ্যের বিক্রি শুরু করেছেন। কেউ-বা খাতার দোকান খুলেছেন। এ-দিকে স্কুলপাঠ্যের বিক্রিও তলানিতে ঠেকেছে। ফলে বন্ধ হয়েছে অনেক কাগজের দোকানও, যারা স্কুল-বই ছাপার কাগজ সাপ্লাই করত। যাদের বন্ধ হয়নি, তারা ওজন দরে খাতা বিক্রি করছেন এখন। এর বাইরে যে বইয়ের মার্কেট নিয়ে আমরা চিন্তিত হয়ে উঠেছি গেল ছ-মাস, তাকে ‘সাহিত্যের মার্কেট’ বলেন বিশেষজ্ঞরা। লকডাউন না আম্ফান, কে খেলো বাজার, তা নিয়ে তর্ক করা সময়ের অপচয়। আমার ব্যক্তিগত মত, বইয়ের ব্যবসা দীর্ঘ সময় ধরেই ধুঁকছে। আমরা বুঝেও বুঝিনি বা বুঝি না।

সরকারি হাতে স্কুলপাঠ্য চলে যাওয়ার পর থেকেই পাবলিকেশন ইন্ডাস্ট্রি ধুঁকতে শুরু করেছিল। আমরা ‘অন্যধারার’ প্রকাশনা তখন চুপ থেকেছি। কেউ কেউ ভেবেছি এতে শিক্ষায় পুরোনো দলতন্ত্রের লাগাম আলগা হয়ে নতুন দলতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সুবিধে হবে। এবার আপনি বলবেন, পাঠ্য-পুস্তকের সঙ্গে আমাদের অন্যধারার সম্পর্ক কী? আমার অল্প দেখায় জেনেছি, যারা জেলা থেকে স্কুলের বই নিতে আসেন তাদের দোকানের জন্য, সঙ্গে উপহারসামগ্রীর লিস্টে গল্প, উপন্যাস ইত্যাদি বইগুলিও থাকে। অনেকে আবার ওই সব দোকানগুলিকেই সিলেবাসের বাইরের বইয়ের অর্ডার দিয়ে দেন। আমার জানা এমন দোকানও কমেছে জেলায়। এবার সমস্যা হল, বাংলা বইয়ের পাঠক তো কেবল কলেজ স্ট্রিটসংলগ্ন এলাকাতেই থাকেন না, সারা দেশ, এখন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে রয়েছেন। বই বিক্রেতা হিসেবে সেই সমস্ত পাঠককে কানেক্ট করবার কোনো চেষ্টাই আমরা করিনি। আমরা কেবল ভেবেছি দোকানের সামনে নিজেদের বইগুলি জ্বলজ্বল করলেই বুঝি ওগুলো দিনের শেষে আউট-অফ-স্টক হয়ে যাবে!

হাওয়াকলের শুরুর দিকে বইয়ের দোকান করব এমন ভাবনা ভাববার সাহস ছিল না। বই রাখা হত কলেজ স্ট্রিটের নানান দোকানে। বছর ঘুরত, বই বিক্রির কিছু টাকা বা হিসবে পেতাম বা পেতাম না। পাঠক অভিযোগ করতেন, বই নেই বলছে, স্লিপ হাতে আমরা গেলে কুমির ছানার গল্পের মতো বইটির কপি দেখিয়ে খেদিয়ে দিতেন দোকানী। বিরক্তি এবং লসের শেষ সীমানায় পৌঁছে ই-কমার্স-অনুসারী হলাম, বই বিক্রি করতে। এবার সমস্যা হল দুটো, বই বেচে হাতে টাকা আসা তো দূরের ব্যপার, উলটে নিজের পকেট থেকে প্যাকেটের খরচ বহন করতে হচ্ছে। ই-কমার্স ভারতের সমস্ত ট্যাক্সের দায় আমাদের ওপরেই চাপিয়ে দিতে চায়!

স্থির করলাম, অন্যের নয়, নিজেদের ই-কমার্স শুরু করব। তাতেও সমস্যার সমাধান কিন্তু হয়ে গেল না। পাঠকের অভিযোগ বই কিনব, ডাক খরচ দেবো কেন? আচ্ছা, কার্ডে পেমেন্ট করলে আমরা তার সমস্ত ডিটেইলস জেনে তার বাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ফাঁকা করে দেবো না তো? পাঁচ বছর টিকে থাকার লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত আমরা জিতেছি। লকডাউন-পরবর্তী সময়ে রেকর্ড সংখ্যক বইয়ের অর্ডার আমরা পেয়েছি এবং ডেলিভারি করেছি। এমনকী, এখনও করে চলেছি। এই বিক্রি কিন্তু কেবল দেশে নয়, সারা বিশ্বেজুড়ে, লকডাউন-পরবর্তী সময়ে হাওয়াকল-শাম্ভবী যা বই বিক্রি করেছে, আমাদের এগারো বছরের প্রকাশনার কেরিয়ারে আগে কখনও হয়নি। লকডাউন চলাকালীনই যখন এ-দেশে প্রথম প্রেস খোলে, দিল্লিতে টানা দু-মাস আমরাই ছিলাম একমাত্র প্রকাশন সংস্থা যারা নিয়মিতভাবে বই প্রিন্ট করাতাম। তবে, লকডাউন অনলাইন ব্যবসাতেও কিছু সমস্যা এনেছে। প্রধান সমস্যা শিপিং। শিপিং খরচ প্রাইভেট কোম্পানিগুলি বাড়িয়েছেন বহুগুণ। ইন্ডিয়ান পোস্ট একসঙ্গে পাঁচটির বেশি প্যাকেট নিতে চায় না, কারণ বুকিং কাউন্টারে পর্যাপ্ত কর্মচারী নেই। অথচ, ইন্ডিয়ান পোস্ট যদি ই-কমার্সকে শিপিং-এ সাহায্য করত, আমার বিশ্বাস সমস্ত ই-কমার্স দেশের প্রতিটি কোণায় বই পৌঁছে দিতে পারতেন হাসিমুখে ও কম খরচে।

এই তথ্যগুলোর পেছনে আমাদের নিজেদের গরিমা অথবা অভিযোগ খুঁজতে যাবেন না। কেবল এটুকু দেখুন বা ভাবুন, বই শিল্পও তো একটা ইন্ডাস্ট্রি; সে কেন পিছিয়ে পড়বে? কেউ বই কেনে না, এমন তো নয়! ভারত এমন এক উন্নয়নশীল দেশ যেখানে লকডাউনের সময়ে বই-কে এসেনশিয়াল প্রোডাক্টের মধ্যে রাখা হয়নি। কেন? কারণ, আমরা বইশিল্পকে বরাবর এলিট ক্লাস ভেবে এসেছি অথবা ভাবিয়েই এসেছি মানুষকে। আমরা দোষ দিয়েছি, লোকে বই পড়ে না। আর ২০১৮ সালের বইমেলায় একজন অস্ট্রেলিয়ার বাসিন্দা এক বাঙালি পাঠক এসে জানান, তিনি বছরে এই সময়টা দেশে আসবার চেষ্টা করেন, কারণ, বাংলা বই তিনি (পড়ুন তারা) বিদেশে পান না। আমরা, বই প্রকাশকরা, ভাবি, বাংলা বইয়ের বাজার আর পাঠক মানেই কলেজ স্ট্রিট!

এ-সব কথা শুনে মনে মনে মুচকি হেসে বলবেন, বিদেশে কত পাঠক আছে হে? বিশ্বাস করুন আছে, প্রায় কুড়ি কোটির ওপর বাঙালি আছেন সারা দুনিয়ায়। তাদের এক শতাংশের কাছে পৌঁছোতে পারলে সংখ্যাটা হয় কুড়ি লক্ষ। ব্যবসায় এই কাস্টোমার বেস খুব কি খারাপ? আসুন, একটু ভাবুন, বই-কে কেবল ফাইন আর্ট করে রেখে দায় সারবেন না, তাকে ইন্ডাস্ট্রির মর্যাদা দিন।

১৩ অগস্ট, ২০২০ | কলকাতা

Tags: No tags

Leave a Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *