তহবিল

কেবল আয়নার দিকে চেয়ে আছি। না, কিছুই দেখছি না তেমন। কেবল নিজের মালভূমি-মার্কা মুখখানা ছাড়া। আজই হঠাৎ খেয়াল করলাম, আমার নাকটা বড্ড উঁচু। যেন গ্লোবের মধ্যে কাঁচা মাটির প্রলেপ দেওয়ার পর কোনও এক অ্যাবস্ট্র্যাকটআর্টিস্ট ভারি মজাক করে এক তাল মাটি চাপিয়ে পাহাড় গড়ে দিয়েছে! কানের ঠিক উপরে আমার বাদামী ত্বক কেটে সাদা পায়ে-চলা পথ তৈরি করেছে নাছোড় বান্ধবী, চশমা। আরে, এতক্ষণ খেয়ালই করিনি, সামনের চুলগুলোকে… কুশঘাসের মত ধারালো ভাবে খাড়া হয়ে ঠিক ঘাড়ের কাছে এসে আবার ঝুঁকে পড়েছে। অদ্ভুত তো! এতদিন যারা চুল কেটেছে খেয়াল করেনি? এবার এটাকে কী করে ঠিক করা যায় একটা পরামর্শ নিতে হবে। সকালেহাঁটা অভ্যেস করতে হবে। সামনের মাংসল উপত্যকা এভারেস্ট হয়ে উঠেছে। এভারেস্ট? চূড়ায় হাত দিই। এত গরম কেন? তুষারপাত হয়নি? ডাক্তারি কায়দায় বললাম, এতে কোনও সমস্যা হবে না। উষ্ণায়ন প্রকোপ নয়। স্নান করে নাও। বুকের কাছে হাত দিলাম। বেশ ঠাণ্ডা। এ-সি রুমে শব্দের স্তর, প্রায় ছুঁয়ে দেখা যায়। প্রেমের গান চলছে স্পিকারে। আহা! স্নিগ্ধতা চাপকে যায়। শাওয়ার চালিয়ে দিই।বাঁ হাতের তালুতে বডি-ওয়াশ মৃদু গন্ধ ছড়িয়ে আদর করবার অপেক্ষায়। প্রবল শব্দে শাওয়ার ক্রমশ মুছে দিচ্ছে বাজতে থাকা গান, “…দেখলো হামকো করিবসে/ আজ হাম মিলে হে নসিব সে…”

আকাশ পরিষ্কার থাকলে নাকি শীতলখুচি থেকে ভুটানের পাহাড় দেখা যায়। গাড়িতে আসতে আসতে দেবাঞ্জনদা বললো। দেবাঞ্জনদা বরানগরের ছেলে। এখানে কলেজে পড়ান। আজ পাহাড় দেখা যাচ্ছে না। আকাশ মেঘে ঢাকা। পশ্চিমে মেঘের ফাঁকফোকর দিয়েই সূর্য নেমে যাচ্ছে প্রকাণ্ড জ্বলন্ত সিগরেট মুখে। ‘এখানে খুব ভালো আকাশ দেখা যায়’। দেবাঞ্জনদা জানলার দিকে তাকিয়ে বললো। দুপাশে ধান ক্ষেত, তিন-চার দিন আগেও বর্ষার জলে ডুবে ছিলো। মাঠের পাশে কচুপাতায় এখনওপলির স্তর লেপটে আছে। কলাগাছের গোড়ার রঙ এখনও কাদাটে। প্রশ্ন করলাম,‘তোমার এখানে থাকতে প্রথম-প্রথম কষ্ট হয়নি?’ ‘শরীর খারাপ করেছিল। বাইরে খেতাম বলে। এখন বেশ লাগে’। গাড়ি হুঁশ করে চার-পাঁচটা পরিবারের জনপদ পেড়িয়ে গেল। এগুলোও বন্যার জলে ডুবেছিলো ক-দিন আগ পর্যন্ত। এখন বাড়িগুলোর চার দেওয়াল নগ্নতা ঢেকে দাঁড়িয়ে আছে। মেঝে? জানলা দিয়ে পিছনে তাকালাম, গতিতে কয়েক সেকেন্ডে দেখলাম, কাঠের মেঝে ভেঙে ভেসে গেছে। ঘাড় সোজা করতেই রাস্তার উপর ভেজা খাট, কাঁঠাল-কাঠের ভেজা আলমারি, আধ-শুকনো তোষক ডাই করে রাখা। পচাগড় মোড়ের চায়ের দোকানে সকালেই শুনেছি হাসপাতাল পাড়ার পাশ দিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না। রাস্তা জুড়ে ভেজা তোষক আর বাতাস জুড়ে তুলো-পচা গন্ধ। বিপ্লব হাসপাতাল পাড়ায় থাকে। জিজ্ঞেস করলাম, যে বাড়িগুলো ভেঙে গেছে তাদের মেরামতের ক্ষতিপূরণ আসবে না? দীর্ঘশ্বাস চেপে বললো, ‘ও কিছু আসবে না হয়ত! আসতে না আসতেই…’ প্রবল হাওয়ায় কপালের উপর আমার কয়েক গাছা চুল এসে পড়ল। এমন হওয়ার কথা নয়! সকালে বেশ করে হেয়ারজেল ঘষেছি চুলে। অখাদ্য সব এগুলো! পয়সার শ্রাদ্ধ! বলে কিনা চব্বিশ ঘণ্টা কাজ দেয়! ঢপ! উফ, কাশী হয়েছে। কাকুরও (কৌশিকের বাবা) নাকি সর্দি-কাশি হয়েছিল। এ ক-দিন বুক-জলে ত্রাণ বিলি করেছেন। বয়স হয়েছে, এসব বোঝেন না ওঁরা! কৌশিকের থেকে জানতে চাইলাম আজ কি ভারত-শ্রীলঙ্কার ম্যাচ আছে? কৌশিক খেলা দেখে না। আমিও দেখি না। চ্যাম্পিয়ান ট্রফিতে পাকিস্থানের কাছে হারটা এখনও হজম হয়নি।

আজকাল পরিশ্রান্ত হয়ে উঠলে মুখেরবাঁদিকটা ফুলছে। প্রথমে ভেবেছিলাম আয়নাটার গোলমাল। দু-তিনটে আয়না ঘুরে কনফার্মড, মুখ ফুলছে। এর একটা ট্রিটমেন্ট দরকার। পিছনের টিভিতে মুখ্যমন্ত্রী ‘রাইজিং বেঙ্গল’-এর খতিয়ান তুলে-তুলে ছুড়ছেন… কে জানে কার মুখে!আয়নায় সব উলটো হয়ে যায়। মুখ বুঝতে পারছি না। কাকু পেপার পড়ছেন। ফ্রন্ট-পেজ। বুক-জলে দিনাজপুরে ত্রাণ নিচ্ছে চাষাভুষোরা। ফেসবুক ওয়ালে নেতাজীইন্ডোরে দেব-জিৎ-এর সাথে মাননীয়ার ছবি, নতুন কবিতা লিখেছে কেউ কেউ, ঘুরতে এসেছি বনে/ সেলফি তুলি জলে, ফাঁকতালে কে যেন বন্যা ত্রাণের আবেদন জানিয়েছেন। কমেন্টে একজন লিখেছেন ট্যাক্সের টাকার একটা অংশ নাকি এই সব ন্যাচারাল ক্যালামিটিসের জন্য যায়, সে ফান্ড কোথায়? কে জানে বাবা, ট্যাক্স দিয়েদিয়েছি, গপ্প শেষ। এবার ট্যাক্স জলে যাবে না, কারও ঘরে যাবে সে সরকার বুঝবে! মনটা খুঁত-খুঁত করছে, মুখটা ফুলছে কেন?

এতটা লিখে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। কোথাও কাব্যি করিনি তো? দরদী হতে হবে লেখাটা। বুড়ো নীল আঙুলের হাততালি দরকার। এখানে এসেই পেনের নিবটা একটা চক্কর কেটে এলো। দায়-দায়িত্ব-মনুষ্যত্ব… থাম বাপ আমার! বৃষ্টি আমার জন্য হয়নি, নদীকে আমি বাঁধিনি, ভুটান আমার জন্য জল ছাড়েনি, তোমাদের ত্রাণ আমি খেয়েও নিইনি। ঘর গেছে, আবারগড়েও নেবে। টাকা নেই, তো? মহাজন আছে। ক্ষেত গেছে, ভিক্ষে কর। দরকারে আত্মহত্যা। আমার এসবে দায় নেই। আমি কেবল নির্মেদ গদ্য লিখবো, আর মাছের পেটিখানা থেকে মাংস খুবলে খেয়ে পেটিএমে যদি কিছু থাকে পাঠিয়ে দেব কোনও ‘বন্যাত্রাণ তহবিল’-এর অ্যাকাউন্টে।

আজ মাছের ঝোলটা বেড়ে হয়েছিলো।

ছবি ঋণ: বিপ্লব সরকার (মাথাভাঙ্গা)

Tags: No tags

Leave a Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *